আলব্রাটোর মনটা আজ খুব খারাপ। বাবা এখনো এ মাসের খরচের টাকাটা পাঠাইনি। এদিকে মেসের ভাড়া দেওয়ার সময়টা পেরিয়ে গেছে।পকেট হাতড়ে দেখলো দশ টাকার দুটি পুরাতন নোট যেন চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে ঝিমিয়ে পড়েছে। আলব্রাটো টাকাটা পকেটে রেখেই বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো।বালিশের পাশে সিগারেটের প্যাকেটটা থেকে অবশিষ্ট একটি ডার্বি সিগারেট বের করে কালো ঠোঁটে গুঁজে দিলো।তারপর একরাশ ধোঁয়াছেড়ে ভাবতে লাগলো-আচ্ছা, যদি টাকা ছাপানোর একটা মেশিন আমার কাছে থাকতো? তবে বেশ হতো। এই বিকালে শুয়ে না থেকে মার্গারেটাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম।আজসন্ধ্যায় দুজনে নীল আর্মস্ট্রংও বাজ অলড্রিনএর স্মৃতিসৌধের উদ্দেশ্যে রওনা দিতাম।আমার মেস থেকে যেতে কয়েক ঘন্টার ব্যাপার মাত্র।বাবার কাছে নীল আর্মস্ট্রং আর অলড্রিনের এর অনেক গল্প শুনেছি। এই দুইজন মহান মানুষ-ই প্রথম এখানে এসেছিলেন। ঐতিহাসিক বিষয়গুলো আমার মত মার্গারেটেরও খুব পছন্দ। ও নিশ্চয় আপত্তি করতো না! ভাবতে ভাবতে আলব্রাটোর মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো। ইস ! পকেটে যদি এখন পর্যাপ্ত টাকা থাকতো তবে মাইন্ড ক্যাফেতে গিয়ে মনটা ভালো করে আসতো। সত্যিই অসাধারণ এক ক্যাফে, ওখানে মন ভালো করতে প্রতি ঘন্টার জন্যে ৫ টাকা করে নেয়।তারপর মন খারাপ এর সমস্ত ব্যাপার একেবারে উধাও। কিন্তু পকেটে যে টাকা আছে সেই টাকা থেকে ৫ টাকা চলে যাওয়ার চিন্তাটা দুঃসাহসিকতার পর্যায়ে পড়ে। যদি পৃথিবীতে এমন একটা যন্ত্র থাকতো? ও ভাবলো- এবার বাড়ীতে যাওয়ার সময় পরিবারের সবার জন্যে মন ভালো করার একটা যন্ত্র নিয়ে যাবে। অবশেষে আর কোনো উপায় না দেখে ক্রিকেট খেলার জন্যে ব্যাট আর বল হাতে মাঠের দিকে রওনা হলো। পৃথিবীতে সে তার অধিক ওজনের কারনে খেলতে পারতো না কিন্তু এখানে এসে তার ১২০ কেজির ভারি শরীরটার ওজন ২০ কেজি অনুভূত হওয়ায় সে সমস্যা একেবারেই নেই। এখন সে ছুটতে পারে, খেলতে পারে অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যে। আলব্রাটো মেস থেকে বেরিয়ে মাঠের দিকে সরু পথ ধরে হাটতে আরম্ভ করলো।পথের দু-পাশে ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের পাথরের সমারোহ একেবারে চোখ জুড়িয়ে যায়। পৃথিবীতে অক্সিজেনের জন্যে গাছ রোপণ করলেও এখানে গাছের বালাই নেই। এখানকার পাথরে ৪৫% অক্সিজেন থাকায় এখানকার সরকার এখানে পাথর রোপণ করা বাধ্যতামূলক করেছে।আর এখানকার আদি বাসিন্দাগুলোও অত্যন্তপরিবেশ সচেতন।যদিও পৃথিবীতে থেকে আসা আমাদের মতো অভিবাসীদের জন্য অবস্থাটা অনেক পরিবর্তন হয়েছে।রাস্তার দুপাশে মাঝে মাঝে দেখা মেলে উঁচু উঁচু লাল পাথরের ঝর্ণার পাহাড়। সে ঝর্ণার জলের মুখে বাধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে।সেই বিদ্যুৎ দিয়ে চলছে এখানকার কলকারখানা,আবাসিক ভবন,অফিস -আদালত।ও হ্যাঁ আদালত শব্দটা এখানে পরিত্যাজ্য। কারন এখানে কোনো আদালত নেই,নেই থানাপুলিশ। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারবেন সমস্ত অঞ্চল।কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না মনের ভুলেও। আপনি কোনো অচেনা জায়গা যেতে চাইলে রাস্তার মোড়ের ইন্টারনেট বুথ থেকে আপনার ঠিকানাটা খুজে নিতে পারবেন খুব সহজেই। আরেকটি বিষয় সত্যিই অবাক করবে আপনাকে, এখানকার শপিংমলে কেনাকাটা করে নিজ দায়িত্বে মূল্য পরিশোধের মতো ব্যবস্থা আছে যেখানে বিক্রেতার উপস্থিতি আপনার চোখে পড়বে না। অথচ কেউ একটা পয়সা কম দিচ্ছে না। এসব বিষয় আলব্রাটোকে মুগ্ধ করে সারাক্ষণ। আলব্রাটো ইতোমধ্যে খেলার মাঠে চলে এসেছে।সমস্ত বিকেলটা ক্রিকেটীয় আনন্দে কাটিয়ে সন্ধ্যা নামতেই মেসের দিকে পা বাড়ালো সে। মেসে এসে দেখলো বাবা টাকা পাঠিয়েছে।প্রাপ্তিস্বীকার পত্র দিয়ে বাবার পাঠানো ড্রোনটাকে ফেরত পাঠালো সে। তারপর মার্গারেটকে ফোন করে স্টেশনে আসতে বলে নিজে বের হওয়ার জন্যে তৈরী হলো।স্টেশনে পৌছে দেখলো মার্গারেট আগেই চলে এসেছে।তারা দুজনে ট্রেনের একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় প্রবেশ করলো।কামরায় রাখা টিকিটবক্স থেকে মূল্য পরিশোধ করে চাঁদের রাণীর প্রাচীন মহলে যাবার দুটি টিকিট সংগ্রহ করলো। যথাসময়ে ট্রেনটি তার গন্তব্যের দিকে রওনা হলো। চাঁদের রেল ব্যবস্থাপনা আমাদের দেশের মতো সময়ের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন নয়।যদি কখনো যাত্রাপথে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয় তবে তার বিকল্প ব্যবস্থা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই করা হয়।সুতরাং ভ্রমণটা আপনার জন্যে আরামদায়ক হবে এ নিশ্চিয়তা আপনাকে দিতে পারি। গণপরিবহনের এরুপ ব্যবস্থাপনার কারনেই এখানকার পর্যটনশিল্পের উন্নতি চোখে পড়ার মতো। ঘন্টা দুয়েক পরে ট্রেনটা তাদের যাত্রার শেষ প্রান্তে এসে থামলো। তারা ট্রেন থেকে নেমে একটা ছোট্ট একটা অটো রিকশা ভাড়া করলো। পৃথবীর অটোরিকশার মতো ম্যানুয়াল কিছুই এখানে নেই। ড্রাইভিং সিটে বসে চালক কম্পিউটার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যাত্রাপথের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেন আর রিকশাটি আপনাআপনি এগিয়ে চলে লক্ষ্যের দিকে।এই রিকশায় আছে - শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা, প্রাথমিক চিকিৎসার টুলবক্স,হাতের কাছেই পাবেন বিভিন্ন ধরনের গল্পের বই আর ম্যাগাজিন। এককথায় ভ্রমণের ক্লান্তি আপনাকে স্পর্শ করতে পারে এমন কোনো উপাদান এখানে নেই। ট্রাফিক সিগনালের লালবাতি জ্বলে উঠলে সাথে সাথে সমস্ত যানবাহনগুলো থেমে যায়।কোনো হণের্র শব্দ নেই,তাড়াহুড়ো নেই, ঘন্টার পর ঘন্টা যানজট নেই,রাস্তার ফুটপাতে যত্রতত্র হকার নেই,পথচারী পারাপারে ট্রাফিক আইনের লঙ্ঘন নেই।রাস্তার ডিভাইডারে পাথরের সজ্জা,রাস্তা থেকে অনেকটা দূরে উঁচু উঁচু ভবনের উপর পাথরের চোখ জুড়ানো কারুকার্য। এসব দেখতে দেখতে আলব্রাটো আর মার্গারেট অভিভূত। আরেকটি বিষয় তাদের আরও অবাক করলো- এখানে কেউ ডাস্টবিনের বাইরে কোনো আবর্জনা ফেলে না, রাস্তার মাঝে নেই খানাখন্দ, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা অসাধারণ। তারা ভাবলো- আমাদের দেশ যদি এমন করে সবুজ বৃক্ষে পূর্ণ হতো! নির্মল অক্সিজেন টেনে নিতে পারতাম ফুসফুসে।ভাবতে ভাবতে অটোরিকশা এসে থামলো রাণীর চাকচিক্যময় সুদৃশ্য বাড়ীর গেটে। রিকশা থেকে নেমে তারা দুজন ঢুকে পড়লো রাণীর মহলে।মহলের সদর দরজার পাশে ডিজিটাল মনিটরে নজর পড়লো চাঁদের সমস্ত পরিচয়।
জন্ম: পৃথিবী থেকে,এর ব্যাস-৩,৪৭৬ কি.মি.,পৃথিবী থেকে গড় দূরত্ব-৩,৮৪,৪০১ কি.মি., পৃথিবী থেকে সর্বনিম্ম দূরত্ব-৩,৬৩,২৯৭ কি.মি. ,পৃথিবী থেকে সর্বোচ্চ দূরত্ব-৪,০৫,৫০৫ কি.মি.,কক্ষীয় পর্যায়-২৭ দিন ৭ ঘন্টা ৪৩ মিনিট ১২ সেকেন্ড,ঘূর্ণন কাল-২৭.৩২ দিন, চন্দ্র মাস-২৯ দিন ১২ ঘন্টা ৪৪ মিনিট ৩ সেকেন্ড,ভর-৭.৩৪২দ্ধ১০২২ কেজি,ঘনত্ব-৩.৩৪ গ্রাম/সিসি, অভিকর্ষ-১.৬২ মি/সে২, পৃষ্ঠ তাপমাত্রা-দিনে ৪০০ ডিগ্রী কেলভিন এবং রাতে ১০০ ডিগ্রী কেলভিন।
আলব্রাটো মনিটরে চোখ বুলিয়ে অন্দরমহলে প্রবেশ করলো। প্রশস্ত অভ্যর্থনা কক্ষের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা নীল আর্মস্ট্রং আর অলড্রিনের ছবি,তারপাশে ঝুলিয়ে রাখা এরিষ্টটল,গ্যালিলিও,আলফন্স ফ্রেসা,জর্জ ডারউইন, অটো এমফরার ছবিগুলো আলব্রাটো ও মার্গারেটকে অভিভূত করে। এসব মানুষগুলো পৃথিবীর অথচ তাদের কর্মেও স্বীকৃতি দিতে কুন্ঠাবোধ করেনি এরা। তারা সমস্ত বাড়ীটি খুটে খুটে দেখে অবশেষে রাতের খাবারের জন্যে প্রাসাদের গেটের বাইরে একটি হোটেলে প্রবেশ করে। হোটেলের ভিতরের পরিবেশ একেবারে ছিমছাম।কোথাও মাছির ঘ্যানঘ্যান নেই,টেবিলগুলো স্বচ্ছ পরিষ্কার,বাসন আর নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ কানে আসে না তাদের।খাবার অর্ডার দিতেই পৌচ্ছে যায় সমস্ত খাবার। রাতের খাবার শেষ করে আলব্রাটো মেসের দিকে রওনা দেয়। একটা অসম্ভব মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ শেষ করে ফিরে আসে যে যার স্থানে।তারপর একটা পরিপূর্ণ ঘুম থেকে উঠে সকালে ক্যাম্পাসের বাস ধরে ভার্সিটিতে পৌছে। এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা পৃথিবী থেকে একেবারেই ভিন্ন। এখানে ক্লাসে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা বিরস লেকচার হজম করতে হয় না।একগাদা বইয়ের স্তুপ পিঠে করে বইয়ে বেড়াতে হয় না।অভিভাবকের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তে অখাদ্য গলাধঃকরণ করার নিয়ম এখানে নেই। এখানে সবকিছু নিজের মর্জিমাফিক। যেটা ভালো লাগে সেইটা করতে পারবেন।সব কিছু হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়। অর্থনীতি,বিজ্ঞান,ভাষা শিক্ষা, নৈতিকতার শিক্ষা, সাহিত্যচর্চা কোনো কিছুই পাঠ্যপুস্তকের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। গ্রেডিং সিস্টেম কাকে বলে এটাই বুঝে না চাঁদের অধিবাসীরা। কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি চাকরীর নিশ্চয়তা এখানে শতভাগ। আলব্রাটো আনন্দদায়কভাবে সারাদিন ক্যাম্পাসে কাটিয়ে বিকালে মেসে ফেরে। মার্গারিটাকে ফোন দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে। তারপর রাতের খাবার শেষে ঘুমিয়ে পড়ে পরের দিনটা শুরু করার আশায়। হঠাৎ কানের কাছে বিকট শব্দে বেজে উঠে ফোনটা।তাড়াহুড়ো করে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে তখন সকাল নয়টা বেজে গেছে।রুমে আর কেউ নেই সবাই ক্যাম্পাসে গেছে হয়ত। রুমের চারদিকে খেয়াল করে দেখে চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কাপড়-চোপড়। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না কি ঘটেছে এখানে? রাতেও দিব্যি সাজানো গোছানো ছিলো ঘরটা।হঠাৎ স্মরণ হয় বাবার পাঠানো টাকার কথা। প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখে দশ টাকার ময়লা দুটি নোট। মুহূর্তেই বুঝতে পারে সবকিছু। ফিরে আসে বাস্তবতার কাছে। রাতের স্বপ্নটা তাকে আসলেই ঘোরের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো এতোক্ষণে স্পষ্ট হয় তার কাছে। বোকামির একটা হাসি খেলে যায় তার ঠোটের কোণে। সে হাসির রেখা গ্রাস করে ফেলে রাস্তার গাড়ীগুলোর বিকট হাইড্রোলিক হণের্র শব্দ। সামনে এসে দাঁড়ায় আরেকটি যানজটময় অভাবী দিনের শুরু।
৩০ সেপ্টেম্বর - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪